মহসীন শেখ

আলহামদুলিল্লাহ, মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে এবং মা-বাবা সহ সকলের দোয়ায় স্বস্ত্রীক পবিত্র ওমরাহ হজ্ব পালনে গিয়ে দীর্ঘ ২৫দিনের যাত্রায় ৪বার পবিত্র উমরাহ্ হজ্জ পালনের সুযোগ হয়েছে। পবিত্র আল্লাহ্র ঘর তাওয়াফ করেছি বেশ কয়েকবার। আল্লাহর ঘরের দরজা এবং গিলাফ ধরে নিজের জন্য ছাড়াও সকল মুসলিম উম্মাহ্র জন্য মনভরে দোয়া করেছি। মসজিদুল হারামে নামাজ আদায়ের সুযোগ হয়েছে বেশ কয়েকবার। জুমার নামাজও আদায় করার সুযোগ হয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হাজি সহ বহু মুসলিম ভাইয়ের সাথে। পবিত্র কাবা শরীফের মূল দরজার পাশে থাকা মাকামে ইব্্রাহিম অর্থাৎ যে পাথরে দাঁড়িয়ে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস আল্রাহর ঘর নির্মাণ কাজ করেছেন সেই পাথরটিও দেখেছি বহুবার। ৪টি ওমরাহ্ পালনকালে প্রতিবারই ৭বার করে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে তাওয়াফ করেছি। বহুবার চেষ্টার পর চুমু খেতে সক্ষম হয়েছি হাজরে আসওয়াদে অর্থাৎ কালো পাথরে।
প্রতিনিয়ত পবিত্র মসজিদুল হারাম আর কাবা ঘরকে ঘিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ওমরাহ্ হজ্জ করতে আসা লাখো হাজী ছাড়াও স্থানীয় মানুষদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। এছাড়ার পবিত্র স্থান ঘিরে যেন জীবন্ত ইসলামকেই দেখতে পেয়েছি, সুবহানআল্লাহ্। আল্লাহ্র রহমতে ঘেরা এই স্থানকে কেন্দ্র করে যেন মানুষের মাঝে মানুষের অপুরন্ত ভালবাসা, সম্মান আর অতুলনীয় আতিতীয়তা। যা বলে কখনই শেষ করা যাবেনা। পবিত্র হেরাম শরীফের ভেতরে বাইরে বিশেষ যতœ করে বসানো রয়েছে পবিত্র জমজমের পানি। যেখান থেকে একগ্লাস পানি পান করলেই জুড়িয়ে যায় মনপ্রাণ। মিটে যায় সকল তৃষœা। সকলেই যে যার মতো সু-শৃংখলভাবে মহান সৃষ্টিকর্তার সানিধ্য পাবার লক্ষ্যে ইবাদতে মশগুল।
পবিত্র কাবা শরীফ তাওয়াফকালে সকলের একই শোর ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হা¤দা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা’ ধ্বনীতে এক প্রশান্তির সৃষ্টি হয়। তখন মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত অংকে দুরে ছুঁড়ে ফেলে শুধুই আল্লাহ্র ইবাদতে মগ্ন থাকতে। পবিত্র মসজিদুল হেরামে সৌদিআরবের বাসিন্দা ছাড়াও বিভিন্ন মানুষ যে যার মতো হাজীদের মাঝে তবরুক বিতরণ করছে। ওমরাহ্ পালন করতে যাওয়া অনেকেই এই তবরুক খেয়ে দিনরাত ইবাদত করে যাচ্ছে নিজের গুণাহ্ মাফ চেয়ে এবং বিভিন্ন মনের বাসনা পূরণ করতে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নারী পূরুষ হাজীদের মাঝে যেন কোনই ভেদাবেদ নেই, তাদের সকলের চোঁখ শুধুই পবিত্র আল্লাহ্র ঘরের দিকে। বিশেষ করে পবিত্র আল্লাহ্র ঘরের দরজা এবং গিলাফ ধরলেই সেই যেই হোকনা কেন দুই চোঁখের পানি আটকে রাখা সম্ভব হয়না কারো।

চলতি বছরের ০১মে সৌদি আরবে পৌঁছেই যথা নিয়মেই নাবিল নামের এক ছোট ভাই ও স্ত্রীকে আমরা ১ম ওমরাহ্ হজ্জ আদায় করি। নিয়ামানুয়ায়ী মসজিদুল হারাম অর্থাৎ পবিত্র হেরাম শরিফে দু’রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করেই প্রতিবার পবিত্র ওমারাহ্ এবং পবিত্র কাবা তাওয়াফ করি। আল্লাহ্র ঘর তাওয়াফকালে দেখা প্রিয় ছোট ভাই তরুণ আওয়ামীলীগ নেতা কাজী মোরশেদ আহমদ বাবুর সাথে। আরবে নিজের দেশের কোন ব্যক্তিকে দেখলেই নিজের মধ্যে সাহস বাড়ে।

যাই হোক প্রথমে ওমরাহর ফরজ কাজ সম্পন্ন করতে প্রথমে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সেরে গোসল বা অজু করি, তারপর সেলাইবিহীন দুইটি সাদা কাপড় পরিধানের মাধ্যমে ওমরাহর ইহরাম বাঁধে ওই সমজিদে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেছি। সেখানেই ওমরাহর নিয়ত করেই- ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হা¤দা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা’ (যার অর্থ;- অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে হাজির, আমি তোমার দ্বারে উপস্থিত, আমি হাজির, তোমার কোনো অংশীদার নেই, তোমার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামতের সামগ্রী সবই তোমার, (সর্বযুগে ও সর্বত্র) তোমারই রাজত্ব, তোমার কোনো অংশীদার নেই) এই দোয়াটি পরতে পরতে পবিত্র কাবা শরীফে ছুটে যাই। পৌঁছেই মসজিদুল হারামে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে ইহরামের চাদরকে ডান বগলের নিচের দিক থেকে পেঁচিয়ে এনে বাঁ কাঁধের ওপর অর্থাৎ ইজতিবা করে পবিত্র আল্লাহর ঘর তাওয়াফ সম্পন্ন করেছি যতবার ওমরাহ্ হজ্জ আর কাবা তাওয়াফকালে।

ওসময় যথানিয়মে মাকামে ইবরাহিমের(অর্থাৎ কালো পাথর) পেছনে বা মসজিদুল হারামের যেকোনো স্থানে তাওয়াফের নিয়তে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা হয়। তাওয়াফ শেষ করেই দু’রাকাত নামাজ পড়ে সাফা ও মারওয়া পাহাড় তাওয়াফ করি।

সাফা ও মারওয়া তাওয়াফ করেছি লাখ লাখ হাজিদের সাথে। সকলেই নির্দিষ্ট দোয়া পড়ে পবিত্র এ পাহাড় দুইটি সাঈঅর্থাৎ তাওয়াফ করেন। আল্রাহ তাআলার ঘর কা’বা শরিফের সন্নিকটে এ সাফা এবং মারওয়া নামক পাহাড় দুটির অবস্থান। এক সময় পাহাড়গুলো অবিকল থাকলেও বর্তমানে আরো সংস্কার করে মেঝেতে মার্বেল পাথর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। সাফা ও মারওয়া দুটি পাহাড়ের নাম। প্রাক ইসলামি যুগে পোত্তলিকরা এ পাহাড়দ্বয়ের ওপর দুটি মুর্তি স্থাপন করে তাদের পূজা করতো। ইসলামের আবির্ভাবের পর সাফা ও মরাওয়া তাওয়াফ (সাঈ) করার জন্য নির্দেশিত হলে মূর্তি পূজার কারণ তারা সাফা ও মারওয়ায় তাওয়াফ নিষিদ্ধ কাজ মনে করে। তখন আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন যে, সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তাআলার নির্দশন। নিশ্চয় সাফা এবং মারওয়াহ আল্লাহ তাআলার নিদর্শন সমূহের অন্যতম।

হাদিসে বর্ণিত- আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর শিশু সন্তান হজরত ইসমাইল ও স্ত্রী বিবি হাজেরাকে জন-মানবহীন মরুপ্রান্তর মক্কায় রেখে আসেন। সেখানে বিবি হাজেরা কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হন। কোনো মানুষজন নেই, খাবার পাণীয়ের ব্যবস্থা নেই। সেখানে শিশুপুত্র ইসমাইল এবং তাদের পানির সংকট দেখা দেয়। তিনি পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যখানে দৌড়াদৌড়ি করেন। যা আল্লাহ তাআলার অনেক পছন্দ হয়েছিল।

সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের এ ঐতিহাসিক স্থানে বিবি হাজেরা ও তাঁর পুত্র যে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন, এ কষ্টের সময় তারা যে সবর বা ধৈর্য অবলম্বন করেছিলেন। সে কারণেই আল্লাহ তাআলা তাদের স্মরণে সাফা ও মারাওয়া পাহাড়ের সাঈকে হজ ও ওমরা আবশ্যক করে দিয়েছেন।

এ কারণেই আল্লাহ তাআলা সাফা ও মারওয়া পাহাড়কে আল্লাহ তাআলা নিদর্শন ঘোষণা করেছেন। সেখানে যারা যে কাজই করুক না কেন, সেটা দেখার বিষয় নয় বরং তা ইসলামেরই নিদর্শন।

বহুবার চেষ্টা করে হাজরে আসওয়াদে চুমু খেতে হয়েছে। হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া অনেক কষ্টের ব্যাপার। বলতে গেলে পাথরে চুমু দিয়ে সুস্থভাবে ফিরে আসাটা অনেক দূরহ ব্যাপার। হজ্জ বা উমরার অংশ হিসেবে হাজিরা তাওয়াফ করে থাকেন। এর শুরুতে হাজরে আসওয়াদ চুমু দেয়া রীতি রয়েছে। ফ্রেমে মুখ ঢুকিয়ে হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করতে হয়। এর পাশে ২৪ ঘণ্টা উপস্থিত থাকে সৌদি পুলিশ। তারা খেয়াল রাখে, ফ্রেমে মাথা ঢোকাতে বা চুম্বন করতে কারও যেন কষ্ট না হয়। তবে চুমু দেয়া সম্ভব না হলে হাত ইশারা করে তাওয়াফ শুরু করা হয়।

হাজরে আসওয়াদ (আরবি ভাষায়: الحجر الأسود‎ যার বাংলা অর্থ: কালো পাথর) হল একটি কালো রঙের প্রাচীন পাথর যা কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফ থেকে দেড় মিটার (চার ফুট) উঁচুতে অবস্থিত। এই পবিত্র পাথরের দৈর্ঘ্য ৮ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৭ ইঞ্চি। মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী এই পাথর আদম ও হাওয়ার সময় থেকে পৃথিবীতে রয়েছে। এর আরো অনেক ইতিহাস রয়েছে এই অল্প পরিসরে ব্যখ্যা করা সম্ভব নয়।

মাকামে ইব্রাহিম অর্থাৎ অর্থাৎ যে পাথরে দাঁড়িয়ে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস আল্রাহর ঘর নির্মাণ কাজ করেছেন হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর মতে, মাকামে ইবরাহিম ঐ পাথরকে বলা হয়। যে পাথরে দাঁড়িয়ে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস আল্রাহর ঘর নির্মাণ কাজ করেছেন। এই স্থানে দাড়িয়ে দোয়া করার সুযোগ দান করেছেন আল্লাহ্পাক।

আজও এ পাথরে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কদম মুবারকের চিহ্ন বিদ্যমান।

এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর ঘর নির্মাণের সময় যখন দেয়াল ক্রমান্বয়ে উঁচু হতো তখন ঐ পাথরও হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে নিয়ে ওপরে উঠতো।

হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর খিলাফাতের সময়কালে বন্যার স্রোতে এ পাথরটি ভেসে যায়। পরে তিনি তা সংগ্রহ করে বাইতুল্লহ হতে একটু দূরে পাথর দিয়ে স্থায়ীভাবে পরিবেষ্টিত করে রেখে দেন। সে সময় থেকে আজও এ পাথরটি ঐ একই স্থানে রয়েছে। এ পাথরটিতে অন্তত একটিবার চুমু খেতে লাখো কৌটি হাজিরা প্রতিনিয়ন প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পবিত্র কা’বা শরীফ তাওয়াফ, পবিত্র মসজিদুল হারামে নামাজ আদায় ও সাফা মারওয়া তাওয়াফ করা সহ সব মিলিয়ে এ যেন এক অন্যরকম অনুভুতি।

হে আল্লাহ্, যেন সকল মুসলমানকে পবিত্র সৌদিআরবে জীবন্ত ইসলামকে দেখার সুযোগ দান করুণ, আমীন।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের কক্সবাজার। মোবাইল:- ০১৬১৯০৭০৫১৩